সর্বশেষ
বিশ্ব মঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘মানবপুতুল’ নৃত্য: ওসাকা এক্সপোতে যাচ্ছে ক্ষুদে শিল্পীরা পদ্মার ইলিশ কোথায় হারাল? স্বাদের রাজা এখন নাগালের বাইরে জোঁকের তেল: গোপন শক্তি না গোপন বিপদ? কী বলছে চিকিৎসা বিজ্ঞান? “বিয়ের জন্য আপনি প্রস্তুত তো? জেনে নিন চূড়ান্ত আত্মবিশ্লেষণের ৬টি দিক” আজ মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ডিএমপির ডাইভারশন নির্দেশনা—এড়িয়ে চলুন এই সড়কগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক ভিসায় নতুন শর্ত: আবেদনেই জমা দিতে হতে পারে ১৮ লাখ টাকার বন্ড টাঙ্গাইলে ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক গ্রেফতার রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ফজলে এলাহী গ্রেফতার বিয়ে ছিল ফাঁদ! ৮ স্বামীকে ফাঁসিয়ে কোটি টাকা হাতানো সামিরা নবম বিয়ের আগেই গ্রেপ্তার প্রেমের ফাঁদে চা, তারপর অজ্ঞান! পাত্রী গ্রেপ্তার, জব্দ হওয়া মোবাইল গেল বাংলাদেশে

খাগড়াছড়ির ভালোবাসা: হাতি ‘ফুলকলি’র করুণ অধ্যায়

প্রতিবাদী কণ্ঠ
  • আপডেট সময় : ০৩:৪১:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫ ১১৬ বার পড়া হয়েছে

খাগড়াছড়ির ইতিহাসে ‘ফুলকলি’ এক অনন্য নাম। ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর মানবিকতার প্রতীক হয়ে থাকা এই হাতিটির গল্প শুনলে আজও চোখ ভিজে আসে পুরোনো খাগড়াছড়িবাসীর।

এই গল্পের শুরু প্রায় ৭৫ বছর আগে। ১৯৫০ সালের দিকে জন্ম নেওয়া ফুলকলি নামে হাতিটিকে ১৯৬২ সালে খাগড়াছড়ির তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক হাবিবুল ইসলাম নিজের বাহন হিসেবে নিয়ে আসেন। সেসময় খাগড়াছড়ি ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক প্রত্যন্ত মহকুমা, যেখানে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। দুর্গম পাহাড়ি পথে চলাচলের একমাত্র নির্ভরতা হয়ে ওঠে ফুলকলি। প্রশাসকের যাতায়াতের বাহন হলেও, খুব অল্প সময়েই সে হয়ে ওঠে পুরো এলাকার মানুষের আপনজন।

গ্রামের মানুষের কাছে ফুলকলি ছিল স্নেহভাজন অতিথি। কেউ তাকে ডেকে আদর করত, কেউ খাওয়াত পাকা কলা, কাঁঠাল, ছোলা, গম আর কলাগাছ। ফুলকলির প্রতি মানুষের ভালোবাসা যেমন ছিল নিঃস্বার্থ, তেমনি ফুলকলিও গড়ে তোলে এক গভীর আত্মিক বন্ধন।

১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডেও দেখা যায় ফুলকলির সরব উপস্থিতি। সে সময় জেলা প্রশাসকেরা ফুলকলির পিঠে চড়ে বিভিন্ন স্থানে যেতেন। ধীরে ধীরে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ে, আর অবসর নিতে শুরু করে ফুলকলি। তবে রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোতে শহরের মাঠে অনুষ্ঠিত প্যারেডে ফুলকলি ছিল সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—সবাইকে সে অভিবাদন জানাত মাথা নত করে।

পাহাড়ি দুর্ঘটনায় আটকে পড়া যানবাহন উদ্ধারে ফুলকলির অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। খাদে পড়ে যাওয়া গাড়ি টেনে তোলার কাজটা সহজ করে তুলেছিল এই বিশাল প্রাণী। প্রতিদিন তার খাবারের তালিকাও ছিল বিশাল—এক ছড়ি পাকা কলা, পাঁচটি পাকা কাঁঠাল, পাঁচ কেজি ছোলা, পাঁচ কেজি গম, আর প্রতি তিন দিনে এক গাড়ি কলাগাছ।

তবে সব ভালোবাসার গল্পের মতো এ গল্পেরও এক বেদনার অধ্যায় রয়েছে।
একবার পাহাড়ে ঘুরতে গেলে ফুলকলির সামনে আসে একদল বুনো হাতি। তারা ফুলকলিকে দলে নিতে চায়, কিন্তু ফুলকলি যায় না। তার অবাধ্যতায় ক্ষিপ্ত হয়ে বুনো হাতিরা দলবেঁধে আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে ফুলকলির বাঁ পায়ের পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভেটেরিনারি চিকিৎসক আসেন তাকে বাঁচাতে। সে সময় ফুলকলির দেখাশোনায় ছিলেন শশী বিন্দু চাকমা নামের এক নিবেদিতপ্রাণ কম্পাউন্ডার, যিনি আজ অবসরজীবন কাটাচ্ছেন।

প্রায় আড়াই মাস ধরে চলে চিকিৎসা। তারপর ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই, এক ঝুমবৃষ্টির দিনে ফুলকলি আবার আলুটিলা পাহাড়ে যায়। কেউ জানত না, সেটাই হবে তার শেষ ভ্রমণ। হঠাৎ এক সময় সে বেখেয়ালে খাদে পড়ে যায়। সেখানেই তার করুণ মৃত্যু হয়।

পরে একটি ক্রেন এনে তাকে পাহাড় থেকে তোলা হয় এবং যথাযথভাবে তাকে সমাহিত করা হয়।

আজও খাগড়াছড়ির মানুষ স্মরণ করে সেই সহানুভূতির প্রতীক হাতিটিকে। ফুলকলি শুধুই এক পশু ছিল না—সে ছিল ভালোবাসার, দায়িত্বের, আর ইতিহাসের এক জীবন্ত চরিত্র।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

খাগড়াছড়ির ভালোবাসা: হাতি ‘ফুলকলি’র করুণ অধ্যায়

আপডেট সময় : ০৩:৪১:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

খাগড়াছড়ির ইতিহাসে ‘ফুলকলি’ এক অনন্য নাম। ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর মানবিকতার প্রতীক হয়ে থাকা এই হাতিটির গল্প শুনলে আজও চোখ ভিজে আসে পুরোনো খাগড়াছড়িবাসীর।

এই গল্পের শুরু প্রায় ৭৫ বছর আগে। ১৯৫০ সালের দিকে জন্ম নেওয়া ফুলকলি নামে হাতিটিকে ১৯৬২ সালে খাগড়াছড়ির তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক হাবিবুল ইসলাম নিজের বাহন হিসেবে নিয়ে আসেন। সেসময় খাগড়াছড়ি ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা এক প্রত্যন্ত মহকুমা, যেখানে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। দুর্গম পাহাড়ি পথে চলাচলের একমাত্র নির্ভরতা হয়ে ওঠে ফুলকলি। প্রশাসকের যাতায়াতের বাহন হলেও, খুব অল্প সময়েই সে হয়ে ওঠে পুরো এলাকার মানুষের আপনজন।

গ্রামের মানুষের কাছে ফুলকলি ছিল স্নেহভাজন অতিথি। কেউ তাকে ডেকে আদর করত, কেউ খাওয়াত পাকা কলা, কাঁঠাল, ছোলা, গম আর কলাগাছ। ফুলকলির প্রতি মানুষের ভালোবাসা যেমন ছিল নিঃস্বার্থ, তেমনি ফুলকলিও গড়ে তোলে এক গভীর আত্মিক বন্ধন।

১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হলে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডেও দেখা যায় ফুলকলির সরব উপস্থিতি। সে সময় জেলা প্রশাসকেরা ফুলকলির পিঠে চড়ে বিভিন্ন স্থানে যেতেন। ধীরে ধীরে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ে, আর অবসর নিতে শুরু করে ফুলকলি। তবে রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোতে শহরের মাঠে অনুষ্ঠিত প্যারেডে ফুলকলি ছিল সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—সবাইকে সে অভিবাদন জানাত মাথা নত করে।

পাহাড়ি দুর্ঘটনায় আটকে পড়া যানবাহন উদ্ধারে ফুলকলির অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। খাদে পড়ে যাওয়া গাড়ি টেনে তোলার কাজটা সহজ করে তুলেছিল এই বিশাল প্রাণী। প্রতিদিন তার খাবারের তালিকাও ছিল বিশাল—এক ছড়ি পাকা কলা, পাঁচটি পাকা কাঁঠাল, পাঁচ কেজি ছোলা, পাঁচ কেজি গম, আর প্রতি তিন দিনে এক গাড়ি কলাগাছ।

তবে সব ভালোবাসার গল্পের মতো এ গল্পেরও এক বেদনার অধ্যায় রয়েছে।
একবার পাহাড়ে ঘুরতে গেলে ফুলকলির সামনে আসে একদল বুনো হাতি। তারা ফুলকলিকে দলে নিতে চায়, কিন্তু ফুলকলি যায় না। তার অবাধ্যতায় ক্ষিপ্ত হয়ে বুনো হাতিরা দলবেঁধে আক্রমণ করে। সেই আক্রমণে ফুলকলির বাঁ পায়ের পাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুরু হয় দীর্ঘ চিকিৎসা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভেটেরিনারি চিকিৎসক আসেন তাকে বাঁচাতে। সে সময় ফুলকলির দেখাশোনায় ছিলেন শশী বিন্দু চাকমা নামের এক নিবেদিতপ্রাণ কম্পাউন্ডার, যিনি আজ অবসরজীবন কাটাচ্ছেন।

প্রায় আড়াই মাস ধরে চলে চিকিৎসা। তারপর ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই, এক ঝুমবৃষ্টির দিনে ফুলকলি আবার আলুটিলা পাহাড়ে যায়। কেউ জানত না, সেটাই হবে তার শেষ ভ্রমণ। হঠাৎ এক সময় সে বেখেয়ালে খাদে পড়ে যায়। সেখানেই তার করুণ মৃত্যু হয়।

পরে একটি ক্রেন এনে তাকে পাহাড় থেকে তোলা হয় এবং যথাযথভাবে তাকে সমাহিত করা হয়।

আজও খাগড়াছড়ির মানুষ স্মরণ করে সেই সহানুভূতির প্রতীক হাতিটিকে। ফুলকলি শুধুই এক পশু ছিল না—সে ছিল ভালোবাসার, দায়িত্বের, আর ইতিহাসের এক জীবন্ত চরিত্র।