পদ্মার ইলিশ কোথায় হারাল? স্বাদের রাজা এখন নাগালের বাইরে

- আপডেট সময় : ০৫:৫৫:৪৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৫ ২৩ বার পড়া হয়েছে
একসময় বর্ষার দিনের আনন্দ বাড়িয়ে দিত পদ্মার সুস্বাদু ইলিশ। বাঙালির রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়ত সেই স্বাদ আর ঘ্রাণের মাদকতা। কিন্তু এখন, ভরা মৌসুমেও পদ্মার ইলিশ যেন আকাশের চাঁদ—খুব কমই দেখা মেলে। বাজারে ইলিশ থাকলেও পদ্মা-মেঘনার স্বাদ-গন্ধযুক্ত ইলিশ এখন দুষ্প্রাপ্য। প্রশ্ন উঠছে—ইলিশ গেল কোথায়?
ইলিশের অভিযাত্রা ও বিপন্নতা
ইলিশ প্রকৃতিতে পরিভ্রমণশীল মাছ। প্রধান আবাস সাগর হলেও প্রজননের সময় ছুটে আসে মিঠা পানির নদীতে। বিশেষ করে বর্ষায় উজানের পানির স্রোতে সাগর ছেড়ে নদীর দিকে ছুটে আসে ইলিশের ঝাঁক। মোহনা পার হয়ে তারা পৌঁছে যায় পদ্মা-মেঘনার গভীরে, যেখানে গড়ে উঠে অনন্য স্বাদ ও গন্ধ। এ কারণেই সাগরের চেয়ে নদীর ইলিশের চাহিদা বেশি।
কিন্তু আজ আর আগের মতো দেখা মেলে না সেই দৃশ্যের। নদীতে ইলিশের যাত্রা রুদ্ধ হচ্ছে অবৈধ জাল, দূষণ এবং নাব্য সংকটের কারণে। দক্ষিণের সাগর মোহনায় হাজার হাজার জাল ফেলেন জেলেরা, যার মধ্যে অধিকাংশই অবৈধ কারেন্ট বা মশারি জাল। ফলে সেগুলো পেরিয়ে খুব কম সংখ্যক ইলিশ পৌঁছাতে পারে নদীর গভীরে।
নদীশূন্য জেলে, শূন্য বাজার
ঝালকাঠির বিষখালী নদী, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা, লক্ষ্মীপুরের মেঘনা, ভোলার তেঁতুলিয়া—সবখানেই এখন এক রকম চিত্র। জেলে বলছেন, মাছের পরিমাণ কমতে কমতে এখন প্রায় নেই বললেই চলে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে পেশা বদল করছেন।
চাঁদপুর সদরের হরিণাঘাটের জেলে জলিল গাজী বলেন, “আগে নদীতে জাল ফেললেই ইলিশ উঠত, এখন দিনের পর দিনেও জালে কিছু পড়ে না।” একই কথা বলেন ঝালকাঠির জেলে সেন্টু, যিনি মাছ ধরা ছেড়ে এখন চায়ের দোকান দিয়েছেন।
চাঁদপুর বড়স্টেশনের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী সুমন খান জানান, একসময় প্রতিদিন আড়াই-তিন হাজার মণ ইলিশ বিক্রি হলেও এখন নেমে এসেছে মাত্র দুই-তিনশ মণে। তার ভাষায়, “পদ্মা-মেঘনার ইলিশ এখন পাওয়া যায় খুবই সামান্য।”
আকাশছোঁয়া দাম, হাতছোঁয়ার বাইরে ইলিশ
স্বাদ আর গন্ধের জন্য চাঁদপুরের ইলিশ বাজারে সবসময়ই চাহিদাসম্পন্ন। কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় দাম এখন নাগালের বাইরে। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে তো বটেই, এমনকি ইলিশের ‘বাড়ি’ চাঁদপুরেও সাধারণ মানুষ ইলিশ কিনতে পারছেন না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত ১৭ জুন চাঁদপুর জেলা প্রশাসন গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইলিশের ‘প্রকৃত দাম’ নির্ধারণের কথা জানায়। তবে তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
অভিযোগ বনাম বাস্তবতা
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ হাজার টন ইলিশ উৎপাদনের দাবি করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই তথ্য বাস্তব চিত্রের সঙ্গে মেলে না। মতিরহাট ঘাটের আবদুল খালেক মেম্বার বলেন, “নাব্য না ফিরলে নদীতে ইলিশ থাকবে না। এখনকার অবস্থা খুবই করুণ।”
জেলে রুবেল বলেন, “একবার নদীতে গেলে ৪-৫ হাজার টাকা খরচ হয়, অথচ মাছ বিক্রি করে পাওয়া যায় দেড়-দুই হাজার টাকা।”
পদ্মার সেই স্বপ্নময় ইলিশ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষেরই অজ্ঞতা, অবহেলা ও লোভের কারণে। অবৈধ জাল, নদীর নাব্য সংকট, অপরিকল্পিত মাছ আহরণ, পরিবেশ দূষণ—সব মিলিয়ে এই দুর্দশা। এখনই সময় সচেতন হওয়ার। নাহলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম হয়তো শুধু বইয়ের পাতায়ই পড়বে পদ্মার ইলিশের গল্প।