সর্বশেষ
বিশ্ব মঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘মানবপুতুল’ নৃত্য: ওসাকা এক্সপোতে যাচ্ছে ক্ষুদে শিল্পীরা পদ্মার ইলিশ কোথায় হারাল? স্বাদের রাজা এখন নাগালের বাইরে জোঁকের তেল: গোপন শক্তি না গোপন বিপদ? কী বলছে চিকিৎসা বিজ্ঞান? “বিয়ের জন্য আপনি প্রস্তুত তো? জেনে নিন চূড়ান্ত আত্মবিশ্লেষণের ৬টি দিক” আজ মানিক মিয়া এভিনিউয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ডিএমপির ডাইভারশন নির্দেশনা—এড়িয়ে চলুন এই সড়কগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক ভিসায় নতুন শর্ত: আবেদনেই জমা দিতে হতে পারে ১৮ লাখ টাকার বন্ড টাঙ্গাইলে ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক গ্রেফতার রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ফজলে এলাহী গ্রেফতার বিয়ে ছিল ফাঁদ! ৮ স্বামীকে ফাঁসিয়ে কোটি টাকা হাতানো সামিরা নবম বিয়ের আগেই গ্রেপ্তার প্রেমের ফাঁদে চা, তারপর অজ্ঞান! পাত্রী গ্রেপ্তার, জব্দ হওয়া মোবাইল গেল বাংলাদেশে

কীভাবে আমাদের মানসিক চাপ কমানো সম্ভব

সম্পাদকীয়
  • আপডেট সময় : ১০:১৩:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫ ৯৪ বার পড়া হয়েছে

আমরা মনের উপর চাপকে মানসিক চাপ বলি, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘টেনশন’। এই ইংরেজি টেনশন শব্দটি বাংলাতেও বহুল প্রচলিত। কোথাও আসতে টেনশন, যেতেও টেনশন। এখন জানতে হবে আমাদের মনটা কী? দেহের কোথায় তার অবস্থান। আমাদের শরীরে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে এর মধ্যে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যাকে আমরা বলি, মন। এই মনই আমাদের দেহস্থিত পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে পরিচালনা করে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মতো মনের আকৃতিকে ভাষায় বোঝানো যায় না। মনকে দেহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা খুব কঠিন। দেহে থেকেই যে সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় তা কখনো কল্পনাও করা যায় না। নিজের বাড়িতে বসে যে কেউ আগের দেখা পছন্দমতো জায়গায় মনের আকাশে ইচ্ছেমতো ঘুরে আসতে পারে এবং তাতে তার মুখে দেখাবে অসাধারণ প্রশান্তি আর অনাবিল আনন্দ। কিন্তু এই মনের মধ্যেই যদি পরিবেশগত, পরিবারগত বা কার্যসূত্রের কোনো কারণে চাপ সৃষ্টি হয় তাহলে সেটাকে দূর করা অবশ্যই দরকার। তা না-হলে আমাদের সংসারে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা দুর্বিষহ হয়ে উঠে। মানসিক চাপে মানুষ নাজেহাল হয়ে যায়। এই চাপজনিত কারণে মানুষের মনের মধ্যে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তা থেকে জন্ম নেয় স্বাস্থ্যভগ্নতা এবং সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগ। আমাদের মনের মধ্যে অনেক সময় পরস্পর বিরোধী আশা-আকাক্সক্ষা দানা বাঁধে এবং কে কার আগে পূর্ণ হতে পারে তারই একটি প্রতিযোগিতা ভিতরে ভিতরে চলতে থাকে। তখন দেহজ কামনার সাথে মনোলোকে বাসনার যুদ্ধ বাঁধে। তার থেকেই জন্ম হয় মানসিক চাপ আর অস্থিরতা।

মানসিক চাপে আমরা মনের পাঁচটি অবস্থা কথা জানতে পারি। প্রথমত: ক্ষিপ্ত অর্থাৎ অত্যন্ত অশান্ত। দ্বিতীয়ত: মূঢ় অর্থাৎ জড়পদার্থের মতো। তৃতীয়ত: বিক্ষিপ্ত অর্থাৎ কখনও ভালো, কখনও খারাপ। চতুর্থত: একাগ্রতা অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে কোনো কিছুতে নিমজ্জিত, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। পঞ্চমত: নিরুদ্ধ অর্থাৎ সচেতন অবস্থা।

অধ্যাপক আবুল ফজল মনের এই পাঁচ অবস্থার উপর সুন্দরভাবে আলোকপাত করে গেছেন। তার মতে, চিত্ত বা মন যে পাঁচ ধরনের দশায় নিজেকে প্রকাশ করে সেগুলো হল: ছড়িয়ে থাকা ব্যাপ্ত অবস্থা; অন্ধকারদশা; নিয়ন্ত্রণারম্ভ, একমুখিতা ও একাগ্রতা। আধুনিককালে প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ধাপের মানুষের মধ্যেই একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজকাল মা-বাবাদের বাচ্চাদের উপর আশা-আকাক্সক্ষা এত বেশি যে, বাচ্চার দু’তিন বছর হলেই তাদের নাচ, গান, অথবা ছবি আঁকা, লেখাপড়া, সাঁতার সব কিছুই শিখিয়ে ফেলতে চায়, বাচ্চাটির নজর কোনদিকে সেটা ভাবার কারোর সময় বা ইচ্ছা নেই। বাচ্চা সবকিছু শিখতে না-পরলেই টেনশন। কারণ, ‘ওর বাচ্চা, তার বাচ্চা সব কিছু শিখে ফেলছেÑ হায়, হায়, আমার বাচ্চাটির কিছুই শিখা হলো না।’ এভাবে ত্রিমুখী টেনশনের শিকার হচ্ছে একেকটি পরিবার। তবে বাচ্চাই বলুন অথবা কিশোর-কিশোরী, যুবক, বৃদ্ধই বলুনÑ সবার ক্ষেত্রে এই মানসিক চাপ বা উদ্বেগ থেকে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের রোগ। যেমন- ব্লাড প্রেসার, হৃদরোগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত। মনকে শান্ত টেনশনমুক্ত রাখার অশেষ প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক কালের শতকরা নব্বই শতাংশ মানুষই নিমেষের জন্য মনকে শান্ত রাখতে পারে না। চতুর্দিকের পরিবেশই আমাদের মনকে অশান্ত করে তোলে, উদ্বেগমুক্ত থাকতে দেয় না।

আমাদের অস্থির মনকে উদ্বেগমুক্ত করে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। সারাদিনের অতি ব্যস্ততার মধ্যেও শান্তভাবে কিছুটা সময় বসে থাকার অভ্যাস করা দরকার। মনকে শান্ত রাখার জন্য দিনের কিছুটা সময় নির্দিষ্ট রাখতে হবে এবং কিছুতেই সেই সময়ের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মানসিক চাপ যদি আমাদের বেশি হয় তখন মনকে একই চিন্তায় নিযুক্ত রাখার অভ্যাস করা সম্ভব হয় না। মন অহরহ এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় যাতায়াত করতে থাকে। কিন্তু মনকে এক চিন্তায় নিযুক্ত না রাখলে টেনশন দিন দিন বাড়তেই থাকে। মনে রাখতে হবে, আমরা বেঁচে আছি বর্তমানকে নিয়ে। সুন্দর সুস্থ থাকার মধ্যে হবে মানসিক প্রশান্তি আর টেনশন মুক্তি। কোনো কাজ করতে গিয়ে মতদ্বৈধতায় অর্থাৎ এটা করব, না ওটা করবÑ এই ভাবনায় ভুগলে চলবে না। বর্তমানের কোনো কাজে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে পারলে অতীতের সেই কাজে ব্যর্থতা আবার কখনো ভবিষ্যতের ব্যর্থতার রূপ ধরে আসতে পারে না।

টেনশনমুক্তিতে ইচ্ছাশক্তির সুফল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আবুল ফজল বলেন, ‘উঠে দাঁড়াও নির্ভীক ও শক্তিশালী হও জেনে রেখো তুমিই তোমার ভাগ্যের স্রষ্টা। তোমার মধ্যেই রয়েছে প্রয়োজনীয় শক্তি আর সহায়তা।’ এই ইচ্ছাশক্তি যে-কোনো মানুষের মনে যদি দৃঢ়ভাবে থাকে, তাহলে টেনশন চেষ্টা করেও মনের মধ্যে ঢুকতে পারে না। জর্জ বার্নাডশ’র নাম অনেকেই জানে। তিনি ছিলেন ব্যাঙ্কের একজন ক্যাশিয়ার। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি এত প্রখর ছিল যে তিনি দিনে অন্তত পাঁচ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। তার অন্যথা কখনও হতে দিতেন না। তাঁর ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তাই তাঁকে পৃথিবীখ্যাত বার্ণার্ড শ’ করে তোলে।

মানসিক অবসাদ আমরা তখনই দূর করতে পারি যদি আমরা আমাদের কাজকে ক্লান্তিজনক মনে নাকরে আনন্দদায়ক মনে করি। কারণ আমাদের শান্তি বা ক্লান্তি বেশির ভাগই আমাদের মনে থেকে উদ্ভূত। যদি কখনও মনে হয় কাজই মানসিক অবসাদের কারণ তাহলে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে যাওয়াটাই অবসাদ দূর করার উপায়।
সব সময় মনে রাখা দরকার, মানুষের সকল প্রকার উপলব্ধির উৎস হলো মন। সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, শান্তি-অশান্তি সব কিছুই আমাদের মনের অনুভূতিতে আসে। মানুষ নিজের মনকে যে দিকে চায় সেদিকেই নিতে পারে যেমন সে হাত-পা যে দিকে চাই ঘোরাতে পারে। ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, একই ধরনের টেনশন বা মানসিক চাপে ভুগছে দুটো আলাদা আলাদা পরিবারের কোনও কোনও মানুষ। কিন্তু পরিবারের ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হয়তো একটি পরিবারের সদস্য মানসিক চাপ মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। আবার দৃষ্টিভঙ্গির স্বতন্ত্রতায় অন্য পরিবারের সদস্যটি হয়তো বিষণœতার অতলান্তে তলিয়ে যাচ্ছে।

আজকালকার এই ব্যস্ততার জীবনে আমাদের নিজেদের কথা ভাববার সময় কোথায়? একটু নিশ্চিন্তে দাঁড়াবার সময় পর্যন্ত নেই। আমাদের অনেকের খাওয়া হয়ে যেন গোগ্রাসে গেলা। বর্তমান শতাব্দীতে অধিকাংশ মানুষ চাপে আর উৎপীড়নে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শতাব্দী বলে থাকেন। তাই আমরা ধরেই নিয়েছি বর্তমান শতাব্দীতে বাঁচতে হলে মানসিক চাপ আর উৎকণ্ঠায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচতে হবে।

কিন্তু এটা ভাবলে চলবে না। আমাদের টেনশনমুক্ত জীবনযাপন করতেই হবে। আমাদের নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী আমরা কাজ নেব। যতটুকু আমরা করতে পারি তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে, আনন্দ পেতে হবে। অযথা হা-হুতাশ করলে চলবে না। তাহলেই জীবন সুন্দর হবে আর তা না-হলে মানসিক চাপ আর সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে আমাদের দিন কাটাতে হবে, যা নিশ্চয় কোনো মানুষের কাম্য হতে পারে না।

সর্বাবস্থায় মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়াতেই লুকিয়ে আছে আমাদের শান্তির উৎস, আনন্দের উৎস। টেনশন বা মানসিক চাপ সবকিছুতেই মনই কাজ করছে। তাই মনের নিয়ন্ত্রণে টেনশনেরও নিয়ন্ত্রণ, এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

কীভাবে আমাদের মানসিক চাপ কমানো সম্ভব

আপডেট সময় : ১০:১৩:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

আমরা মনের উপর চাপকে মানসিক চাপ বলি, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘টেনশন’। এই ইংরেজি টেনশন শব্দটি বাংলাতেও বহুল প্রচলিত। কোথাও আসতে টেনশন, যেতেও টেনশন। এখন জানতে হবে আমাদের মনটা কী? দেহের কোথায় তার অবস্থান। আমাদের শরীরে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে এর মধ্যে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়: চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক। আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যাকে আমরা বলি, মন। এই মনই আমাদের দেহস্থিত পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় এবং পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে পরিচালনা করে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মতো মনের আকৃতিকে ভাষায় বোঝানো যায় না। মনকে দেহের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা খুব কঠিন। দেহে থেকেই যে সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় তা কখনো কল্পনাও করা যায় না। নিজের বাড়িতে বসে যে কেউ আগের দেখা পছন্দমতো জায়গায় মনের আকাশে ইচ্ছেমতো ঘুরে আসতে পারে এবং তাতে তার মুখে দেখাবে অসাধারণ প্রশান্তি আর অনাবিল আনন্দ। কিন্তু এই মনের মধ্যেই যদি পরিবেশগত, পরিবারগত বা কার্যসূত্রের কোনো কারণে চাপ সৃষ্টি হয় তাহলে সেটাকে দূর করা অবশ্যই দরকার। তা না-হলে আমাদের সংসারে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা দুর্বিষহ হয়ে উঠে। মানসিক চাপে মানুষ নাজেহাল হয়ে যায়। এই চাপজনিত কারণে মানুষের মনের মধ্যে যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় তা থেকে জন্ম নেয় স্বাস্থ্যভগ্নতা এবং সঙ্গে সঙ্গে নানা রোগ। আমাদের মনের মধ্যে অনেক সময় পরস্পর বিরোধী আশা-আকাক্সক্ষা দানা বাঁধে এবং কে কার আগে পূর্ণ হতে পারে তারই একটি প্রতিযোগিতা ভিতরে ভিতরে চলতে থাকে। তখন দেহজ কামনার সাথে মনোলোকে বাসনার যুদ্ধ বাঁধে। তার থেকেই জন্ম হয় মানসিক চাপ আর অস্থিরতা।

মানসিক চাপে আমরা মনের পাঁচটি অবস্থা কথা জানতে পারি। প্রথমত: ক্ষিপ্ত অর্থাৎ অত্যন্ত অশান্ত। দ্বিতীয়ত: মূঢ় অর্থাৎ জড়পদার্থের মতো। তৃতীয়ত: বিক্ষিপ্ত অর্থাৎ কখনও ভালো, কখনও খারাপ। চতুর্থত: একাগ্রতা অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে কোনো কিছুতে নিমজ্জিত, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। পঞ্চমত: নিরুদ্ধ অর্থাৎ সচেতন অবস্থা।

অধ্যাপক আবুল ফজল মনের এই পাঁচ অবস্থার উপর সুন্দরভাবে আলোকপাত করে গেছেন। তার মতে, চিত্ত বা মন যে পাঁচ ধরনের দশায় নিজেকে প্রকাশ করে সেগুলো হল: ছড়িয়ে থাকা ব্যাপ্ত অবস্থা; অন্ধকারদশা; নিয়ন্ত্রণারম্ভ, একমুখিতা ও একাগ্রতা। আধুনিককালে প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা বেড়েই চলেছে। প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ধাপের মানুষের মধ্যেই একটা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। আজকাল মা-বাবাদের বাচ্চাদের উপর আশা-আকাক্সক্ষা এত বেশি যে, বাচ্চার দু’তিন বছর হলেই তাদের নাচ, গান, অথবা ছবি আঁকা, লেখাপড়া, সাঁতার সব কিছুই শিখিয়ে ফেলতে চায়, বাচ্চাটির নজর কোনদিকে সেটা ভাবার কারোর সময় বা ইচ্ছা নেই। বাচ্চা সবকিছু শিখতে না-পরলেই টেনশন। কারণ, ‘ওর বাচ্চা, তার বাচ্চা সব কিছু শিখে ফেলছেÑ হায়, হায়, আমার বাচ্চাটির কিছুই শিখা হলো না।’ এভাবে ত্রিমুখী টেনশনের শিকার হচ্ছে একেকটি পরিবার। তবে বাচ্চাই বলুন অথবা কিশোর-কিশোরী, যুবক, বৃদ্ধই বলুনÑ সবার ক্ষেত্রে এই মানসিক চাপ বা উদ্বেগ থেকে সৃষ্টি হয় নানা ধরনের রোগ। যেমন- ব্লাড প্রেসার, হৃদরোগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত। মনকে শান্ত টেনশনমুক্ত রাখার অশেষ প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক কালের শতকরা নব্বই শতাংশ মানুষই নিমেষের জন্য মনকে শান্ত রাখতে পারে না। চতুর্দিকের পরিবেশই আমাদের মনকে অশান্ত করে তোলে, উদ্বেগমুক্ত থাকতে দেয় না।

আমাদের অস্থির মনকে উদ্বেগমুক্ত করে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। সারাদিনের অতি ব্যস্ততার মধ্যেও শান্তভাবে কিছুটা সময় বসে থাকার অভ্যাস করা দরকার। মনকে শান্ত রাখার জন্য দিনের কিছুটা সময় নির্দিষ্ট রাখতে হবে এবং কিছুতেই সেই সময়ের উপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মানসিক চাপ যদি আমাদের বেশি হয় তখন মনকে একই চিন্তায় নিযুক্ত রাখার অভ্যাস করা সম্ভব হয় না। মন অহরহ এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় যাতায়াত করতে থাকে। কিন্তু মনকে এক চিন্তায় নিযুক্ত না রাখলে টেনশন দিন দিন বাড়তেই থাকে। মনে রাখতে হবে, আমরা বেঁচে আছি বর্তমানকে নিয়ে। সুন্দর সুস্থ থাকার মধ্যে হবে মানসিক প্রশান্তি আর টেনশন মুক্তি। কোনো কাজ করতে গিয়ে মতদ্বৈধতায় অর্থাৎ এটা করব, না ওটা করবÑ এই ভাবনায় ভুগলে চলবে না। বর্তমানের কোনো কাজে নিজের ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে পারলে অতীতের সেই কাজে ব্যর্থতা আবার কখনো ভবিষ্যতের ব্যর্থতার রূপ ধরে আসতে পারে না।

টেনশনমুক্তিতে ইচ্ছাশক্তির সুফল সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আবুল ফজল বলেন, ‘উঠে দাঁড়াও নির্ভীক ও শক্তিশালী হও জেনে রেখো তুমিই তোমার ভাগ্যের স্রষ্টা। তোমার মধ্যেই রয়েছে প্রয়োজনীয় শক্তি আর সহায়তা।’ এই ইচ্ছাশক্তি যে-কোনো মানুষের মনে যদি দৃঢ়ভাবে থাকে, তাহলে টেনশন চেষ্টা করেও মনের মধ্যে ঢুকতে পারে না। জর্জ বার্নাডশ’র নাম অনেকেই জানে। তিনি ছিলেন ব্যাঙ্কের একজন ক্যাশিয়ার। কিন্তু তাঁর ইচ্ছাশক্তি এত প্রখর ছিল যে তিনি দিনে অন্তত পাঁচ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। তার অন্যথা কখনও হতে দিতেন না। তাঁর ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তাই তাঁকে পৃথিবীখ্যাত বার্ণার্ড শ’ করে তোলে।

মানসিক অবসাদ আমরা তখনই দূর করতে পারি যদি আমরা আমাদের কাজকে ক্লান্তিজনক মনে নাকরে আনন্দদায়ক মনে করি। কারণ আমাদের শান্তি বা ক্লান্তি বেশির ভাগই আমাদের মনে থেকে উদ্ভূত। যদি কখনও মনে হয় কাজই মানসিক অবসাদের কারণ তাহলে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করতে যাওয়াটাই অবসাদ দূর করার উপায়।
সব সময় মনে রাখা দরকার, মানুষের সকল প্রকার উপলব্ধির উৎস হলো মন। সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, শান্তি-অশান্তি সব কিছুই আমাদের মনের অনুভূতিতে আসে। মানুষ নিজের মনকে যে দিকে চায় সেদিকেই নিতে পারে যেমন সে হাত-পা যে দিকে চাই ঘোরাতে পারে। ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, একই ধরনের টেনশন বা মানসিক চাপে ভুগছে দুটো আলাদা আলাদা পরিবারের কোনও কোনও মানুষ। কিন্তু পরিবারের ব্যক্তি বিশেষের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য হয়তো একটি পরিবারের সদস্য মানসিক চাপ মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। আবার দৃষ্টিভঙ্গির স্বতন্ত্রতায় অন্য পরিবারের সদস্যটি হয়তো বিষণœতার অতলান্তে তলিয়ে যাচ্ছে।

আজকালকার এই ব্যস্ততার জীবনে আমাদের নিজেদের কথা ভাববার সময় কোথায়? একটু নিশ্চিন্তে দাঁড়াবার সময় পর্যন্ত নেই। আমাদের অনেকের খাওয়া হয়ে যেন গোগ্রাসে গেলা। বর্তমান শতাব্দীতে অধিকাংশ মানুষ চাপে আর উৎপীড়নে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শতাব্দী বলে থাকেন। তাই আমরা ধরেই নিয়েছি বর্তমান শতাব্দীতে বাঁচতে হলে মানসিক চাপ আর উৎকণ্ঠায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচতে হবে।

কিন্তু এটা ভাবলে চলবে না। আমাদের টেনশনমুক্ত জীবনযাপন করতেই হবে। আমাদের নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী আমরা কাজ নেব। যতটুকু আমরা করতে পারি তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে, আনন্দ পেতে হবে। অযথা হা-হুতাশ করলে চলবে না। তাহলেই জীবন সুন্দর হবে আর তা না-হলে মানসিক চাপ আর সীমাহীন দুর্দশার মধ্যে আমাদের দিন কাটাতে হবে, যা নিশ্চয় কোনো মানুষের কাম্য হতে পারে না।

সর্বাবস্থায় মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়াতেই লুকিয়ে আছে আমাদের শান্তির উৎস, আনন্দের উৎস। টেনশন বা মানসিক চাপ সবকিছুতেই মনই কাজ করছে। তাই মনের নিয়ন্ত্রণে টেনশনেরও নিয়ন্ত্রণ, এটাই আমাদের মেনে নিতে হবে।