আজগর আলীর জীবনমৃত্যুর লড়াই ও মানবতার জয়

- আপডেট সময় : ০৭:২৭:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ জুলাই ২০২৫ ৩৮ বার পড়া হয়েছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল | এক নির্মম বাস্তবতা ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত
প্রতিবাদী কণ্ঠ রিপোর্ট | ৯–১১ জুলাই ২০২৫
৯ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার বিকেল তিনটা।
চকবাজার থানাধীন সড়কের পাশেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ—নাম তার আজগর আলী, বয়স আনুমানিক ৬৫ বছর। পায়ে পোকা ধরেছে, মুখে কোনো শব্দ নেই, শরীর রক্তশূন্য। পথচারীদের চোখ এড়িয়ে থাকা এই অসহায় মানুষটির পাশে দাঁড়ায় মানবিক সংগঠন প্রতিবাদী কণ্ঠ।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল মানেই শুরু হয় নিয়মের পাহাড়। দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা জানান, অস্ত্রোপচার জরুরি—তবে প্রশাসনিক অনুমতি ছাড়া তা সম্ভব নয়।
প্রতিনিধি দল ছুটে যায় চকবাজার থানায়, কিন্তু সেখানে ওসি অনুপস্থিত। পুলিশের লিখিত অনুমতি ছাড়া মেডিকেল কর্তৃপক্ষও নিরুত্তর।
প্রথম ধাক্কা—অনুমতি ছাড়া চিকিৎসা নয়।
এরপর দৌড় শুরু হয় মেডিকেল পুলিশের কাছে। অবশেষে ইন্সপেক্টর ফারুক লিখিতভাবে জানান, পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। এতে শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু এরপরই আসে দ্বিতীয় ধাক্কা—ভর্তি করা হবে না!
রাত তখন বারোটা ছুঁইছুঁই।
একজন রক্তাক্ত রোগী, ক্লান্ত ও অসহায়।
কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কণ্ঠে স্পষ্ট: “ভর্তি নয়।”
মানবিক দায়ে প্রতিবাদী কণ্ঠ নিজ খরচে খাবার, ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে আজগর আলীকে হাসপাতালের বারান্দায় শুইয়ে রাখে।
পরদিন, ১০ জুলাই সকাল থেকে ফের শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ—টিকিট, কাগজপত্র, ওয়ার্ডের নির্দেশনা—সবকিছু শেষে যখন রোগীকে নেওয়া হয় ২১৬ নম্বর ওয়ার্ডে, দায়িত্বরত ডাক্তার সাফ জানিয়ে দেন:
“আমি ভর্তি নেব না।”
প্রতিবাদী কণ্ঠ তখন প্রশ্ন তোলে—
“আপনারা যদি ভর্তি না নেন, এই অবহেলিত মানুষটিকে কোথায় রাখবো?”
তাতে উত্তরে ডাক্তারের নির্মম মন্তব্য:
“যেখান থেকে এনেছেন, সেখানে ফেলে দিয়ে আসুন।”
এই নিষ্ঠুর কথায় প্রতিবাদী কণ্ঠের এক প্রতিনিধি দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে বলেন—
“আমি আমার মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু আজ আপনার মতো ডাক্তার দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি—আর ডাক্তারি পড়াবো না।”
চতুর্থ ধাক্কা—মানবিকতা নয়, নিয়মই মুখ্য।
শেষ চেষ্টা হিসেবে ছুটে যাওয়া হয় শাহবাগ থানায়।
ওসি খালিদ মুনসুর সব শুনে বলেন:

“মানবতার জন্য এমন কাজ আজকাল খুব কম মানুষ করে। আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সম্মান রইল।”
তৎক্ষণাৎ তিনি নির্দেশ দেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে।
তার আদেশে সহকারী এসআই রায়হান ও কিবরিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে চিকিৎসা বিভাগের সাথে সমন্বয় করে ভর্তি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেন।

১১ জুলাই, বৃহস্পতিবার রাত ১২টা।
অবশেষে আজগর আলী ভর্তি হন ২১৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
প্রতিবাদী কণ্ঠের সদস্যরা তখনও পাশে।
তাকে নতুন জামা-কাপড়, লুঙ্গি, ওষুধ ও খাবার দিয়ে নিশ্চিত করেন সব দায়িত্ব।

শেষ কথা নয়, শুরু—মানবতার জাগরণ
আজগর আলীর চিকিৎসা এখনও চলছে। তার জীবনের দুঃসহ এক অধ্যায় হয়তো শেষ হলো, কিন্তু এই ঘটনায় প্রকাশ পেল আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসংবেদনশীল বাস্তবতা।
এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠলো এক কণ্ঠ—
যেখানে সত্য থেমে যায়, সেখানেই জেগে ওঠে প্রতিবাদী কণ্ঠ।